প্রদ্যুতবাবুই প্রথম বাংলা দলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন

পদ্মশ্রী প্রদীপ ব্যানার্জি

(আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কিংবদন্তি ফুটবলার ও কোচ)

শিয়ালদা কাইজার স্ট্রিটের রেল কোয়ার্টার থেকে বৌবাজার সার্পেনটান লেন যেতে হেঁটে বড়জোর ১০ মিনিট লাগে। রেল কোয়ার্টার ছিল আমাদের ঠিকানা। আর সার্পেনটান লেন হল প্রদ্যুত দত্ত - বিশ্বনাথ দত্তর বাড়ি। বেশ কয়েকটা বছর প্রদ্যুৎ দত্তরা সার্পেনটান লেনে থেকেছেন। স্বভাবতই আমার নিকট প্রতিবেশী বলতে হবে।

বাংলার ক্রীড়াজগতে বিশেষ করে ফুটবলে জর্জ টেলিগ্রাফ দীর্ঘদিন (৭০ থেকে ৮০ বছর) ধরে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। সেই ক্লাবের একটা সময় কর্ণধার ছিলেন প্রদ্যুত দত্ত। দীর্ঘকায়, স্বাস্থ্যবান, হাঁটাচলা এবং কথাবার্তায় ছিল প্রবল ব্যক্তিত্বের ছাপ। নিজের হাতে দল গড়তেন। সিনিয়র, জুনিয়র সমন্বয়ে গড়তেন সংগঠিত একটা দল। জুনিয়রদের সঙ্গে রাখতেন তরুণ প্রতিভাবানদের। সিনিয়র বলতে টার্গেট করতেন মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের বাতিল ফুটবলারদের। পুরনো দল বাতিল করার জন্য যাদের মধ্যে একটা জবাব দেওয়ার তাগিদ থাকত। সেই পোড়খাওয়াদের সঙ্গে দলে রাখতেন তরুণ প্রতিভাবানদের। এই কম্বিনেশনে তরুণরা উজ্জীবিত হত। সেই দল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত বড় তিন দলের সামনে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ - এই চারটি বছর জর্জ টেলিগ্রাফ আমাদের ভীষণ বিব্রত করেছে। তারমধ্যে ১৯৭৫ সালে আমি ছিলাম ইস্টবেঙ্গলে। লিগ ম্যাচের প্রথমার্ধে জর্জ টেলিগ্রাফ ফুটবলাররা আমাদের ভারতখ্যাত রক্ষণভাগকে নাকানিচোবানি খাইয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য আমরা তিন গোলে জিতেছিলাম।

সেদিন আমার বড় মেয়ে পলা গুরুতর অসুস্থ ছিল। ভেবেছিলাম খেলা শুরু হওয়ার পর গোল পেলেই চলে আসব। কিন্তু জর্জের আক্রমণের চাপ এতটাই প্রবল ছিল যেজন্য মাঠে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর মোহনবাগানে তো তিনবার জর্জের প্রবল বাধার সামনে পড়েছিলাম। ১৯৭৬-এর লিগে দীর্ঘ ৬ বছর বাদে যখন মোহনবাগান লিগ জিততে যাচ্ছে সেই সময় শেষ দিকে জর্জের বিপক্ষে গোল করতে সুভাষ, আকবর, হাবিবের কালঘাম ছুটেছিল। একইভাবে ওরা চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছিল আইএফএ শিল্ডের সেমিফাইনালে। ১৯৭৮ সালে সব ম্যাচ জিতে কলকাতা লিগ খেতাবের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল জর্জ টেলিগ্রাফ।

এতগুলো তথ্য তুলে ধরার কারণ হল যে দলটাকে গঠন করেছিলেন প্রদ্যুত দত্ত। যে কোনও দলেরই সাফল্যের সিংহভাগ কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে সেই দলের ফুটবলারদের। দলটাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে দলের প্রশিক্ষকের। কিন্তু এক্ষেত্রে আসল কৃতিত্ব হল ক্লাব কর্তৃপক্ষের। তাঁরাই বুদ্ধি খাটিয়ে দল গঠন করে কোচের হাতে তুলে দেন। ভাল, লড়াকু ফুটবলারদের দলে না পেলে কোনও কোচই সাফল্য এনে দিতে পারেন না।

এবারে তাঁর আইএফএ পরিচালনার ক্ষেত্রে দৃঢ়তার কথা বলছি। এ ব্যাপারে তিনি বরাবরই ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ। কলকাতা তথা বাংলার ফুটবল যাতে ভবিষ্যতেও মাথা উঁচু করে চলতে পারে এই ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। তিনি যখন প্রথম সচিব পদে এলেন তখনও কিন্তু ভাস্কর, মনোরঞ্জন, সুব্রত, প্রশান্তরা চুটিয়ে খেলছে। উঠে এসেছে তরুণ দে, কৃষ্ণেন্দু, অলোক, বিকাশ পাঁজি, কৃশানু দে, শিশির ঘোষ প্রমুখ। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তখনও বাংলার ফুটবলারদের দাপট। জুনিয়র ন্যাশনালেও সাফল্য পাচ্ছে বাংলার তরুণ ফুটবলাররা। তবু প্রদ্যুতবাবুর যেন মন ভরছিল না। আগামী দিনের দিকে তাকিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল ফুটবল অ্যাকাডেমি। ঠিক টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির মতো। অ্যাকাডেমির অর্থ হল এক ছাতার তলায় থাকা, খাওয়া, খেলা, লেখাপড়া। এই ব্যাপারে তিনি অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। রাজারহাট - কাদিহাটীতে জমি দেখেছিলেন। সেখানকার স্কুলের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এগোতে পারেননি। হয়তো আইএফএ-র আর্থিক অবস্থা তখন খুব একটা ভাল ছিল না বলেই ইচ্ছে থাকলেও পিছিয়ে এসেছেন। সে যাইহোক, ভাল কিছু করার জন্য তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখানেই তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন।

সন্তোষ ট্রফিতে আমি বাংলা দলের জার্সি গায়ে খেলেছি। ট্রফি জয়ের স্বাদও পেয়েছি একাধিকবার। তার মধ্যে ১৯৫৯ সালে চ্যাম্পিয়ন দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি। বাংলা দলের কোচ হিসাবেও ট্রফি জয়ের স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু ঘটনা হল রেলওয়েতে চাকরি করতাম বলে বরাবরই রেলওয়ে দলের দায়িত্বে থাকতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে একবারই ব্যতিক্রম হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। প্রদ্যুতবাবুই সেবার আমার হাতে বাংলা দলের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। দলটাও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হল কুইলনে নোংরামির শিকার হয়েছিল বাংলা। গট-আপ খেলে আমাদের ছিটকে দেওয়া হয়েছিল।

Copyright Ⓒ Prodyutdutta.com