মেরুদণ্ড ছিল

অশোক দাশগুপ্ত

(সম্পাদক, আজকাল)

এদিক-ওদিক খেলার লেখা শুরু হয়ে গেছে। সওদাগরি কোম্পানিতে মোটামুটি ভাল চাকরির সূত্রে যেতে হয় দেশের নানা শহরে, তাই পুরোদস্তুর স্পোর্টস জার্নালিজম-এ আসার কথা ভাবিনি। লিখছি খেলার আসর-এ, আনন্দমেলায় ঘন ঘন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বললেন, আসা উচিত ক্রীড়া সাংবাদিকতায়, ফুলটাইম। বলে যাচ্ছি, লেখা তো আটকাচ্ছে না। এই সময়ে একটা ফোন আসে অফিসে। নাম শুনেছি, আলাপ ছিল না। প্রদ্যুত (হ্যাঁ, এই বানানেই অনড় ছিলেন তিনি) দত্ত। বললেন, ‘কবে আসবেন বলুন, কথা আছে।’ জিজ্ঞেস করলাম, কেন? হাসি-জড়ানো গলায় জবাব, ‘গোপন ব্যাপার’!

ক্যামাক স্ট্রিটের শান্তিনিকেতন বিল্ডিংয়ের সেই দপ্তর। চা আসার আগেই বললেন, ‘জীবনে অনেক গল্প করা যাবে, আপনার সঙ্গে অনেক দেখা হবে। আগে কাজের কথাটা বলি। একটা ভালো স্পোর্টস ম্যাগাজিন করতে চাই। আপনি না এলে করব না।’ জানালাম, ভাবতে হবে। প্রদ্যুতদা - ‘বেশি ভাবতে নেই। জব স্যাটিসফ্যাকশন আছে আপনার? বিলিতি সিগারেট খেলেই কি সব হয়ে গেল? সময় নিন না। তিন দিন।’

সেদিনই নীরেনদার কাছে গেলাম। এমনিতে প্রায়ই বলতেন, ফুলটাইম স্পোর্টস জার্নালিজম-এ এসে যা। সেদিন একটু সময় নিলেন। বেশি নয়, মিনিট দেড়েক। বললেন, ‘বেশি ভাবলে নতুন কিছু করতে পারবি না। তিনদিন ভেবে লাভ নেই। আজই বলে দে, রাজি।’ ভাবছি, তিন দিন সময় নিয়েছি, তার আগেই বলে দেব? কী আশ্চর্য, দ্বিতীয় দিন সকালে আবার প্রদ্যুত দত্ত - ‘আমার ধারণা, আসছেন। দেরি করে কী হবে? আজ বিকেলে আসুন, ফাইনাল করি। ভাবছেন যে রোজগার অনেক কমে যাবে। একটু কমবে। অনেকটা সামলে দেব। চলে আসুন।’ বিকেলেই দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’। টাকার কথা উঠতেই বললাম, যা পাই ম্যাচ করাতে পারবেন না। উচিতও নয়। কত পাচ্ছি, প্রথম স্যালারির সময় দেখে নেব।

নাম - ‘খেলার কথা’। যিনি ‘খেলার আসর’-এ পরপর লিখিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, সেই চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস (চিরঞ্জীব) শুনে বললেন, ‘তুমি পারবে। শুভেচ্ছা থাকবে।’ অনেক শুভেচ্ছার সঙ্গে পেলাম আরও এক সম্পদকে। বিপ্লব। বিপ্লব দাশগুপ্ত। সর্বার্থে লেফটেন্যান্ট। প্রদ্যুতদার প্রিয়, ধারাভাষ্যকার, খেলার মাঠে অবাধ যাতায়াত। অফুরন্ত পরিশ্রম করে গেল। সঙ্গে আর্টিস্ট হরিমোহন বাগলি। যার ভাই সেই ১৬ আগস্টের শোচনীয় কাণ্ডে ইডেনে প্রাণ হারিয়েছিল। ছাপার ব্যবস্থা উল্টোডাঙায় দীপ্তি প্রিন্টিং-এ। পেয়ে গেলাম প্রেসে দক্ষ নিতাই কুণ্ডুকে, যিনি আমাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িয়ে গেলেন। তাড়া দিতেন, আজ কিন্তু আরও এক ফর্মা ছাড়তে হবে। ছবিটা কিন্তু এখনও পাইনি। কভারে সুরজিতের ছবিটা আরেকটু ভাল পাওয়া যাবে? আর এল পূর্বপরিচিত রতন ভট্টাচার্য ও সরোজ চক্রবর্তী (দ্য গ্রেট)। ফটোগ্রাফার প্রদীপ (বাবু) সোম, প্রদ্যুতদা যাকে বলতেন আমার ‘বাঁয়া তবলা’।

সেই রাতটা ভোলার নয়। পরদিন সকালে পত্রিকা প্রকাশিত হবে। আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে। প্রথম বিজ্ঞাপনের পরেই নানা জায়গা থেকে অর্ডার। এত চাই, এত চাই। কিন্তু, রাত দেড়টায় লোডশেডিং। ইলেকট্রিসিটি লাইন ফেরাতে হবে, ছুটলাম আমি আর বিপ্লব। যখন আশা ছেড়ে দিয়েছি প্রায়, এল। সে এল। বিদ্যুৎ। ভোর পাঁচটা সতেরো মিনিটে ছাপা শেষ। প্রথম কপি নিয়ে আমরা ছুটে গেলাম প্রদ্যুতদার বাড়িতে। পত্রিকায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বললেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশনস। লুচি তো খাওয়াতেই হবে!’ লুচি-পর্বের পর শ্রীচন্দ্র পারিজার কাছে। তিনি তখন আনন্দবাজার-এর ডিস্ট্রিবিউটার। আমাদেরটাও নিয়েছেন। ঢুকতেই বললেন, ‘দশ হাজার বেরিয়ে গেছে, আজই ছাপুন, কাল সকালে আরও দশ হাজার চাই।’ উড়তে উড়তে শান্তিনিকেতন বিল্ডিং-এ। প্রদুতদা বিস্তর মিষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এবং আমার জন্য এক প্যাকেট স্পেশ্যাল সিগারেট। এলেন সুকুমার সমাজপতি। ফ্লুরিজ-এর কেক নিয়ে। মুকুল দত্ত, মতি নন্দী, শান্ত মিত্র, শ্যাম থাপা, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, প্রসূন ব্যানার্জির ফোন। আরও দশ নয়, পনেরো হাজার কপি ছাপার কথা বলে, অভিনন্দন ও কাজ সামলে অফিস থেকে বেরোলাম সন্ধেয়। বিপ্লব ফিরল প্রিয় বেলঘরিয়ায়। আমি বালিগঞ্জের আস্তানায় নয়, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। গোলপার্কেও। প্রথম স্টলে গিয়ে ‘খেলার কথা’ কিনতে চাইলাম। জবাব - শেষ! জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হয়েছে? ‘ফাটাফাটি। কালই পাবেন।’ গড়িয়াহাটের স্টলে কিনতে চাইতেই অন্য অভিজ্ঞতা। ‘নিন, লাস্ট কপি।’ কিনলাম! গোলপার্কে শুনলাম, ‘কারা করেছে? এত ভাল জিনিস, বেশি ছাপাতে পারেনি? কাল অবশ্য আসবে।’

প্রদ্যুতদার স্মরণে ‘খেলার কথা’ নিয়েই এত কথা কেন? মনে করি বাংলার খেলার পত্রিকার জগতে বিরাট ভূমিকা ছিল তাঁর। ব্রডওয়ে পাবলিসিটি-র কর্ণধার। জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউট। জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাব। ময়দানে আরও ব্যস্ততা। কখনও অন্য অফিসের, অন্য জগতের কাউকে পত্রিকা অফিসে আসতে বলেননি। সব আলাদা কম্পার্টমেন্ট। কীভাবে পারতেন, ভেবে অবাক হতাম। এখনও হই।

তারপর, জল গড়াল। ক্রমে আজকাল-এর স্পোর্টস এডিটর। তারপর সম্পাদক। কয়েক বছর দেখা হয়নি প্রদ্যুৎদার সঙ্গে। নার্সিংহোমে দেখতে গেছি উদীয়মান নেত্রী মমতা ব্যানার্জিকে। মিনিটখানেক পরেই ঘরের কোণ থেকে একটা আওয়াজ, ‘অশোক, আমি আছি।’ চেনা গলা, প্রিয় গলা। হাত ধরে বললেন, ‘কবে বাড়িতে আসবে বলো?’

বুদ্ধিমান। সহৃদয়। তবু সব কিছু ছাড়িয়ে যা বলতে ইচ্ছা করে, ছিল মেরুদণ্ড। সে তো সবারই আছে। আসলে থাকে না। চাপের মধ্যেও দেখেছি অনড়। তাঁকে নোয়ানো কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমন মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায়?

Copyright Ⓒ Prodyutdutta.com