এবং প্রদ্যুতদা

মমতা ব্যানার্জী

(মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ)

"Our life is but a winter's day:
Some only breakfast and away;
Others to dinner stay and are full fed;
The oldest man but sups and goes to bed;
He that goes soonest has the least to pay."

প্রদ্যুতদা চলে গেলেন। আই.এফ.এ.’র কর্ণধার প্রদ্যুত দত্ত, আমাদের প্রদ্যুতদা চলে গেলেন ‘মরণসাগর পারে’। সবার কাছে তাঁর পরিচয়, তিনি ছিলেন খেলার মাঠের একজন দক্ষ সংগঠক। কিন্তু আমার কাছে তিনি ছিলেন একান্ত আপনার জন; রক্তের সম্পর্কে আমি হয়তো তাঁর নিজের বোন নই, কিন্তু প্রদ্যুতদা ছিলেন আমার কাছে নিজের দাদা, তিনিও আমাকে নিজের বোনের মতোই স্নেহ করতেন। ১৬ নভেম্বর ’৯৪-এর সেই অভিশপ্ত রাতটা প্রদ্যুতদাকে যেন জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে। একটা দুঃসহ আঘাত এসে মনটাকে যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। অন্তরের অন্তরস্থলটা গুমরে উঠল বোবা কান্নায়, ভাষ্যহীন বেদনায়।

প্রদ্যুতদাকে আমি দেখেছি একজন শক্ত, সবল, দক্ষ মনের মানুষ হিসাবে। তিনি ছিলেন মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বটগাছের মতো। কত মানুষযে সে ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছেন তার কোনো হিসেব নেই। তিনি কখনো কাউকে ভয় পাননি, লড়াই করতেন শেষ পর্যন্ত। মৃত্যুর সঙ্গেও লড়াই করেছিলেন রীতিমতো, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এ লড়াইয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন।

যখনই সময় পেতাম, পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও ছুটে যেতাম প্রদ্যুতদার কাছে। বরাবরই একটু বেপরোয়া ছিলেন। কার কার কথায় আমল দিতেন জানি না কিন্তু আমার সঙ্গে কোনও আলোচনা প্রসঙ্গে আমি যখন রীতিমতো ধমকের সুরে বলতাম, ‘না, এটা ঠিক হচ্ছে না’ প্রদ্যুতদা সঙ্গে সঙ্গে হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে বাবা, তুমি যা বলছো তাই হবে’-এতটাই স্নেহ করতেন আমাকে। রবীন্দ্র সরোবরের ‘সবুজ বাঁচাও’ আন্দোলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্র সরোবরের সবুজ যতদিন থাকবে প্রদ্যুত দত্তও ততদিন থাকবেন মানুষের স্মরণে, মননে।

মাঝে মাঝে যখন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়তাম ছুটে যেতাম প্রদ্যুতদার বাড়িতে। হয়তো তখন তিনি বাড়িতে কোনও মিটিং করছেন। আমি যাওয়া মাত্র খুশি হয়ে বলতেন, ‘মিটিং শেষ, সবাই চলে যান, আমি এখন গল্প করব।’ গল্পের সঙ্গে স্পেশাল কফির আয়োজন তো থাকতই। আমি অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, তাদের সঙ্গে মিশেছি কিন্তু প্রদ্যুতদার মতো এত উদার এবং বড় মনের মানুষ খুব কমই দেখেছি।

প্রদ্যুতদার অকাল প্রয়াণে ক্রীড়াজগতের তো একটা বড় ক্ষতি হলই, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে, আত্মিক দিক থেকে কিছুটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম।

অনাময় নার্সিংহোমে আমি তখন অসুস্থ হয়ে শয্যাবন্দি। সেদিন রাখি পূর্ণিমা। সকাল ৯টায় নতুন সিল্কের পাঞ্জাবি পরে প্রদ্যুতদা এলেন প্রথম মানুষ, যিনি সেদিন বোনের কাছে রাখি পরতে ছুটে গিয়েছিলেন নার্সিংহোমে। নার্সিংহোমে শুয়ে শুয়ে প্রায় হাজার লোকের হাতে আমি রাখি বেঁধে দিয়েছি। কিন্তু রাখি পূর্ণিমার দিনটা যতবার ঘুরে ঘুরে আসবে, মনে পড়বে প্রদ্যুতদার কথা, নার্সিংহোমে আমার ঘরের দরজা খুলে যিনি জিগ্যেস করেছিলেন, ‘মমতা, কেমন আছো?’

রাখি পূর্ণিমার দিনেই শেষ দেখা প্রদ্যুতদার সঙ্গে। মানসিক দিক থেকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। ‘মন খারাপ কেন’- জিজ্ঞেস করতে, বললেন, ‘আই.এফ.এ. ছেড়ে দেব, অনেক ঝামেলা, আর ভাল লাগছে না।’ অনেক বোঝালাম, ধমকের সুরে বললাম, ‘আপনি এত শক্ত মনের মানুষ আর আপনি ভয়ে পালিয়ে যাবেন?’ জানতাম প্রদ্যুতদা কাউকে ভয় পেতে শেখেননি। বললেন, ‘ঠিক আছে, এখনই কিছু ছাড়ছি না। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো তারপর আলোচনা করা যাবে।’ সেদিন প্রায় দেড় ঘন্টা বসেছিলেন আমার ঘরে, একটা অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ার ব্যাপারেও অনেক কথা হল। তখনও জানতাম না প্রদ্যুতদার সঙ্গে এ দেখাই আমার শেষ দেখা!

নার্সিংহোম থেকেই খবর পেলাম প্রদ্যুতদা অসুস্থ হয়ে দিল্লিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চিঠি পাঠালাম- মন ভাঙবেন না, অসুখ মানুষমাত্রেই হয়, সব ঠিক হয়ে যাবে। উনিও উত্তর পাঠালেন-‘আমি সুস্থ হয়ে গেছি, চিন্তা কোরো না।’ অনেকটাই সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর শরীরটাকে এত অবহেলা করতে আরম্ভ করলেন যে আর বাঁচানো গেল না।

অনেকে বলেন, মৃত্যুর আগে মানুষ তার প্রিয়জনকে জানিয়ে দিয়ে যান। যে রাত্রে প্রদ্যুতদা চলে গেলেন, ১৬ নভেম্বর, সেদিন সন্ধ্যায় আমার বহরমপুর রওনা হওয়ার কথা। দুপুরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাৎ কেমন যেন একটা তন্দ্রা মতো এসে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কি না জানি না, ঘুমের মধ্যেই যেন দেখলাম, প্রদ্যুতদা আমাকে কিছু বলতে চাইছেন। ঘুমটা ভেঙে গেল, মনে হল, তবে কি প্রদ্যুতদা আর নেই? সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম প্রদ্যুতদার বিশেষ বন্ধু আনন্দবাজারের শ্যামল চক্রবর্তীকে। শ্যামলদা আর বৌদির সঙ্গে প্রদ্যুতদার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। শ্যামলদা বললেন, ‘ভাল নেই। হয়তো বেঁচে যাবেন কিন্তু শরীরের একটা দিক অবশ হয়ে যেতে পারে।’ আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম, আগে প্রাণটা তো বাঁচুক পরে অন্যান্য চিকিৎসার ব্যবস্থা আমরা করব। কিন্তু অত শক্ত মনের নির্ভীক একজন মানুষকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। তাঁর অনেক স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা ছিল - যা আমি জানি। একদিন হয়তো তাঁর সেই স্বপ্ন আমরা সফল করব কিন্তু সেদিন প্রদ্যুতদাকে তো আর পাব না। এ দুঃখ চিরকাল আমাদের বুকে বাজবে।

বহরমপুরে বসেই পেয়েছিলাম সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। ফেরার পথে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকেই সোজা চলে গিয়েছিলাম প্রদ্যুতদার বাড়ি। যেখানে প্রদ্যুতদা শুয়ে আছেন তাঁর অন্তিম শয্যায়, ফুল, মালা আর ধুপের ধোঁয়ায়। প্রদ্যুতদাকে এভাবে তো কোনওদিন দেখতে চাইনি।

সৌজন্য : ‘উপলব্ধি’

Copyright Ⓒ Prodyutdutta.com