(সেজদি)
দেখতে দেখতে ২৯টা বছর কেটে গেল। প্রদ্যুত আমাদের সঙ্গে নেই। আমরা ৫ ভাই বোন। ভাইদের মধ্যে প্রদ্যুত ছিল সবার ছোট। ওর ডাকনাম ছিল দুলাল। সত্যিই বাবা মা-র আদরের দুলাল। জ্যোতিষী বলেছিলেন মাত্র ৮ বছর বয়সেই হারিয়ে যাবে। বয়সের সেই ফাঁড়া কেটে গেল ১৬ বছর বয়সে। ঈশ্বরের অসীম করুণায় প্রাণে বেঁচে গেলেও একটা পা বাদ দিতে হয়েছিল। নীলরতন সরকার হাসপাতালের সামনে ট্রামের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। ডাঃ এস. আর চন্দ্রর নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন ছিল। কিন্তু এতটাই জখম হয়েছিল যে জন্য পুণেতে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে হয়েছিল। সেখানে জখম পা-টি বাদ দিয়ে কৃত্রিম পা লাগানো হয়। সেই ১৬ বছর বয়স থেকে যতদিন বেঁচে ছিল এক পায়েই দাপিয়ে বেড়িয়েছে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ডানপিটে ছিল। অসীম সাহসী। মনের জোর ছিল প্রবল। তাই এক পায়েই অনেক অসাধ্য সাধন করেছে।
লেখাপড়ার ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিল। তাই বলে সারাক্ষণ বইয়ের সামনে বসে থাকা পছন্দ করত না। এ ব্যাপারে নানারকম বায়ণাক্কা ছিল। আমাদের সার্পেন্টান লেনের বাড়িতে একতলায় জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাবের কয়েকজন ফুটবলার থাকতেন। সেখানেই ওঁদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রদ্যুতকে পড়াবার জন্য তাঁদের মধ্যে একজনকে বাবা দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু ওকে পড়তে বসানোর কাজটা যে কত কঠিন ছিল ব্যাপারটা সেই ফুটবলারটির বুঝতে দেরি হয়নি। যেমন একদিন বলেছিল কাঁধে বসিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে ঘুরিয়ে আনলে তবেই পড়তে বসবে। এরকম আরও অনেক আবদার মিটিয়ে পড়তে বসানো যেত।
আমাদের বাড়ির উঠান অনেকটা বড় ছিল। সেই উঠানে অন্যান্য ভাই এবং পাড়ার ছোটরা খেলত। প্রদ্যুৎ এক পায়েই সেই খেলায় অংশগ্রহণ করত। ৮ বছরের ফাঁড়া অতিক্রম করার পর ওকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। অবশ্য দুষ্টুমি কিছুটা কমলেও সারাদিন একেবারে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে ঘরে বসে থাকত না। তবে রাতে পড়ার সময়ে অত্যন্ত সচেতন থাকত। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ত। তাই সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙত। আমরা যখন পড়তে বসে যেতাম তখন ও ঘুমিয়ে থাকত। টিউটর এসে ঘুম ভাঙাতেন।
আমার বিয়ের তিন মাস আগে মারাত্মক দুর্ঘটনা হয়েছিল। স্বভাবতই গোটা বাড়িতেই ছিল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। তাই আমার বিয়েতে সবাই প্রাণখুলে আনন্দ করতে পারেননি। তবে ঘটনা হল সবাই ভেঙে পড়লেও প্রদ্যুত কিন্তু প্রায় স্বাভাবিক ছিল। যেরকম ছিল অতবড় একটা দুর্ঘটনার পরেও।
দুষ্টুমি করা যার অভ্যাস সেটা কি সহজে ছেড়ে যায়? কোনও সুযোগ পেলেই বড়দা-র পিছনে লাগত। এই ব্যাপারটা নাকি প্রদ্যুতের বড় ছেলে জয়ের মধ্যেও আছে। নিজে যেমন সবসময় বই খাতা নিয়ে বসতে পছন্দ করত না, সেরকম জয়কেও সবসময় পড়তে দেখলে রেগে যেত। একদিন তো জয়ের বই-খাতা ছিঁড়েই ফেলেছিল।
বন্ধুদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা বেশি ছিল ভোলার সঙ্গে। সেই ভোলার পিছনেও লেগেছিল। ভোলা বেছে বেছে ওর পড়ার সময়েই আসত। সেই কারণে একদিন চায়ের সঙ্গে চিনির বদলে সোডা মিশিয়ে দিয়েছিল। সেই চা পান করে ভোলার তো কাহিল অবস্থা। পেটে গন্ডগোল শুরু হয়েছিল। তার আগেই অবশ্য প্রতিষেধক হিসাবে ওষুধও মজুত রেখেছিল। হ্যাঁ দুষ্টুমি করলেও ওর মনটা ছিল শিশুর মতো সরল।