বর্ণময় জীবন

মালবিকা দত্ত

(সহধর্মিণী)

১৯৭৫ সালের ৩ জানুয়ারি আমাদের বিয়ে হয়েছিল। যাদবপুরে বাপের বাড়িতে আমরা সদস্য ছিলাম চার জন। বাবা, মা, দিদি এবং আমি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বউ হিসাবে এলাম সম্ভ্রান্তশালী দত্ত পরিবারে। প্রথমেই জানিয়ে রাখছি এখানে একান্নবর্তী পরিবারে সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। শ্বাশুড়ি মাতা এবং দাদা বৌদিদের স্নেহভাজন হতে পেরেছিলাম।

প্রদ্যুত দত্তরা পাঁচ ভাই এবং সাত বোন। বাবা হরিপদ দত্ত এবং মা শান্তিলতা দেবী। প্রদ্যুত দত্ত ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন সবার আগে। ১৬ নভেম্বর ১৯৯৪ যেদিন তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৩-র আশেপাশে। এককথায় অকালপ্রয়াণ। আমাদের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র অনির্বাণের (জয়) বয়স তখন মাত্র সাড়ে ১৬, কণিষ্ঠ অনিন্দ্য (জিৎ) মাত্র ৯ বছর। এরকম একটা গভীর সঙ্কটের মধ্যে চার দাদা, দিদি, বৌদি, বোনেরা আমাদের পাশে থেকেছেন। তাঁদের সহযোগিতায় অতবড় সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম বলে আজ প্রদ্যুত দত্ত সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি।

আমাদের দাম্পত্যজীবন মাত্র সাড়ে ১৯ বছরের। সেই নিরিখে বলতে পারি তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী। আমাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হত না। আমাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, সাংসারিক দায়-দায়িত্ব সবকিছু আমার উপরেই ছেড়ে রেখেছিলেন।

যখন সহধর্মিণী হিসাবে এই বাড়িতে এলাম তখন তিনি ছিলেন জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবের সচিব। ভবানীপুরে ৩১-এ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের বিশাল বাড়িতে নীচের তলার একটা ঘর ছিল মিনি জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব। সবসময়ই ফুটবলারদের জমায়েত লেগেই থাকত। অনেক সময়ে তাঁদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হত। অনেক সময়ে নিজের হাতে রান্না করে ফুটবলারদের খাওয়াতেন।

বাড়িতে ফুটবলারদের সমাগম আমার খুবই ভাল লাগত। কারণ ছোটবেলা থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত আমিও খেলাধুলা করতাম। কলেজ-জীবনে বেশ কয়েকবার অ্যাথলেটিক্সে প্রাইজও পেয়েছি। তবে খেলার ব্যাপারে খুব বেশি সময় দিতে পারিনি। বাবা খুব কঠোর ছিলেন। প্রতিদিন সন্ধের আগে ঘরে ঢুকতে হত।

বাড়িতে ফুটবলারদের সমাগম আমার খুবই ভাল লাগত। কারণ ছোটবেলা থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত আমিও খেলাধুলা করতাম। কলেজ-জীবনে বেশ কয়েকবার অ্যাথলেটিক্সে প্রাইজও পেয়েছি। তবে খেলার ব্যাপারে খুব বেশি সময় দিতে পারিনি। বাবা খুব কঠোর ছিলেন। প্রতিদিন সন্ধের আগে ঘরে ঢুকতে হত।

বোন, ভগ্নিপতিদের নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতে ভালবাসতেন। মাঝেমধ্যে আমরা সপরিবারে বেরিয়ে পড়তাম। যেমন ১৯৮৮ সালে শিলিগুড়িতে নেহেরু কাপ দেখতে গিয়েছিলাম। বোন, ভগ্নিপতির সঙ্গে জয়-জিৎ এবং আমিও সেই দলে ছিলাম। পূজোর সময়েও বেরিয়ে পড়তাম। সারা বছরের ঝক্কি-ঝামেলা থেকে একটু বিশ্রাম পেতেন তখন। তাঁর পছন্দের জায়গা ছিল শিমূলতলা।

ফুটবলারদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তবে মাঝেমধ্যে তারা কোনও ভুল করলে ধমক দিতেন। আবার পরক্ষণেই ঘরে ডেকে খাওয়াতেন। এই ব্যাপারে আমিও অনেক সময় ওদের ঘরে ডেকে নিয়েছি। বাড়িতে অবাধ বিচরণ ছিল ফুটবলারদের। সেই সূত্রে আমিও ময়দানের প্রিয় বৌদি হয়ে গিয়েছিলাম।

ভোজন রসিক ছিলেন। নিজে যেমন খেতে ভালবাসতেন সেরকম খাওয়াতেও ভালবাসতেন। তাঁর খুব প্রিয় ছিল ইলিশ মাছ ও চিতল মাছের মুইঠ্যা। নিজে রান্না করতেন। আমাকে অনেক সময় সহযোগিতা করেছেন। রান্নার হাতটা খুবই ভাল ছিল।

মস্ত বড় গুণ ছিল যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারতেন। ভবানীপুরের বাড়ি সংস্কারের সময় বিশাল অট্টালিকা ছেড়ে আমরা বেশ কয়েকটা বছর ভাড়া বাড়িতে থেকেছি। প্রথমে বিবেকানন্দপার্কে কমলা গার্লস স্কুলের পাশে। পরবর্তীতে যোধপুর পার্কে, পূর্ণদাস রোড এবং অপূর্ব মিত্র রোডে। অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধা হলেও তিনি মানিয়ে নিয়েছিলেন।

অনেকেই ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আসতেন। তাতে তিনি বিরক্ত হতেন না। সবার সঙ্গেই কথা বলতেন। পাশে দাঁড়াতেন। আসলে তিনি সবাইকে নিয়ে চলতে ভালবাসতেন।

ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে। বিশেষ করে জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউটে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। রক্তচক্ষু, শাসানি অনেক কিছুর মোকাবিলা করে মাথা উঁচু করে চলেছেন। তাঁকে কখনো বিচলিত হতে দেখিনি। বলতেন সব মিটে যাবে। এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল সেই সময়েও।

জীবনে একদিনই তাঁকে বিচলিত হতে দেখেছিলাম। সেদিন পুত্র জয় যখন সাইকেল চালিয়ে আসছিল তখন একটা প্রাইভেট গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল। খবরটা কানে আসতেই ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। আমি তখনই ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলাম। দেখলাম তেমন কোনও আঘাত লাগেনি। ঘরে ফিরে খবরটা দেওয়ার পর স্বস্তি বোধ করেছিলেন। আসলে ব্যক্তিগতজীবনে বিশাল দুর্ঘটনার তিক্ত স্মৃতি সবসময়ই তাঁকে যন্ত্রণা দিত।

ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন ছোট ভগ্নিপতি বিজিত গুহ। বিজিতদার অকালপ্রয়াণে খুবই ব্যথা পেয়েছিলেন। আর ছায়াসঙ্গী ছিল আমার ভাগ্নে দীপু (সুব্রত পাল)। আমার দিদির জ্যেষ্ঠ পুত্র দীপু সবসময়ই সঙ্গে থাকত। দীপুকে বিশ্বাস করতেন। এই দীপুও কয়েকদিন আগে অকালে হারিয়ে গেল। দীপুর আঘাতটা তাঁকে দেখতে হয়নি।

ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ঠাকুর শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথ রাম ঠাকুরের দীক্ষায় দীক্ষিত ছিলেন।

আর একজনের কথা না বললে আমার লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। মমতাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। মমতাও শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। দু-জনের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল ভাই বোনের মতো। মমতা সময় পেলেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। যখন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দিল্লিতে থাকতে হয়েছিল তখন মমতা তাঁর এম পি কোয়ার্টারের বেশ কয়েকটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

অকালেই ইহলোক ত্যাগ করলেন। তবে যে ক-বছর থেকেছেন, খেলার পাশাপাশি, গান-বাজনা, হাসি ঠাট্টা, মজা, হৈ হুল্লোড়েই জীবনটা উপভোগ করেছেন। সবমিলিয়ে বর্ণময়, ব্যতিক্রমী একজন মানুষ। তাঁর সহধর্মিণী হিসাবে আমি সবসময়ই গর্ববোধ করি।

Copyright Ⓒ Prodyutdutta.com